হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ খানা বই মানুষের চামড়া দিয়ে বাধানো আছে। তথ্যটি কতখানি সত্য?
হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের ‘মিস্টার মিসনস উইল’-এ লেখিকার পিঠের চামড়ায় প্রকাশক ট্যাটু করে উইল লিখছে..সেই বর্ণনা পড়ে শিউরে উঠি। ১৮-১৯ শতকে নিগ্রো নেতার শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা লেখার কথা জেনেও আঁতকে উঠি। মধ্যযুগের বর্বর ইউরোপে ক্যাথলিক ধর্মদ্রোহের শাস্তির একটি ছিল জীবন্ত মানুষের শরীর থেকে চামড়া ছিলে ফেলা। অনেক দেশে ইনকুইজিশনের বিচারে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার পাশাপাশি শাস্তি হিসেবে শরীরের চামড়া তুলে সেখানে নুন ছিটিয়ে দেওয়া হত। জলদস্যু পর্তুগিজরা নানা দেশ থেকে মানুষ ধরে দাস হিসেবে বিক্রির সময় হাতের তালু ফুটো করে তার ভেতর দিয়ে দড়ি কিংবা বেতের ছিলা ভরে টেনে আনত।
অবিশ্বাস্য কিন্তু একসময় মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো হত বই। যে প্রক্রিয়াকে ‘অ্যান্থ্রোপোডার্মিক বিবলিওপেজি’ বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে মানুষের চামড়ায় বাঁধানো ৪৭টি বইয়ের খবর পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত ৩২টি বই Peptide Mass Fingerprinting (PMF) এবং Matrix-Assisted Laser Desorption/Ionization (MALDI) পরীক্ষা করে জানা যায় ১৮টি বই মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো। বাকিগুলো বাঁধানো বিভিন্ন প্রাণীর চামড়ায়।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হুতোন লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত The destiny of the soul বা মৃত্যুর পরের জীবন নামের বইটির মলাট মানুষের চামড়ায় তৈরি। বইটি আত্মা সম্পর্কিত একগুচ্ছ প্রবন্ধের সমষ্টি; লেখক ফরাসি কবি ও ঔপন্যাসিক আর্সেন হুসে (১৮১৫-১৮৯৬)। লেখক চিকিৎসক-বন্ধু লুডোভিক বুল্যান্ডকে তাঁর বইটি উপহার দিয়েছিলেন। সেই চিকিৎসক স্ট্রোকে মারা যাওয়া একজন মানসিক রোগিণীর চামড়া দিয়ে বইটি বাঁধাই করেন। পেপটাইড মাস ফিংগারপ্রিন্ট পরীক্ষায় নিশ্চিত যে, বইটির মলাট মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো।
জন হরউড নামে এক তরুণ পাগলের মতো ভালবাসত বালসাম নামে এক তরুণীকে। কিন্তু বালসাম পাত্তা দিত না। এজন্য জন বালসামকে মেরে ফেলার হুমকি দিত। একদিন জন সত্যি সত্যিই বালসামকে খুন করে। বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তার মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করেন রিচার্ড স্মিথ নামে এক চিকিৎসক। তারপর জনের কেসের কাগজগুলো তারই চামড়ার কিছু অংশ শুকিয়ে সেটি দিয়ে বাঁধাই করে রাখেন। বাঁধানো বইটির উপরে রয়েছে মানুষের খুলি ও হাড়ের আড়াআড়ি ছবি, লেখা আছে Cutis Vera Johannis Horwood, যার অর্থ জন হরউডের চামড়া। বইটি রয়েছে ব্রিস্টলের রেকর্ড অফিসে।
পৃথিবীর নানা দেশে মানুষের চামড়ায় বই বাঁধাই হয়েছে। সবথেকে বেশী হয়েছে বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সে। ফরাসি বিপ্লবের পর মানুষের মৃতদেহের অভাব ছিল না। পশুর চেয়ে মানুষের চামড়া সহজলভ্য হয়ে পড়ায় নানা দফতরের নথি, দিনলিপি, স্মারক এমনকি জন মিল্টনের কবিতার বই পর্যন্ত মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই হয়েছে। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই ধরণের একটি বইয়ের নমুনা মিলেছে যার সময়কাল আনুমানিক ১৮৯৩।
পঞ্চদশ লুইয়ের পর থেকে ফরাসি রাজাদের যে বংশলতিকা তৈরি করা হয়েছে সেই বইও মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা। এছাড়া ‘রেলিগাতাম দ্য পেল্লে হিউমানা’ কিংবা ‘রিলাইই এন পিয়াউ হিউমানি’ শীর্ষক লিপিগুলিও একই ধরণের উদাহরণ। মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা বইয়ের ব্যাপক প্রচলন ঘটে উনিশ শতকের গোড়ায়। বিখ্যাত ফরাসি লেখক মার্কুইস দ্য সাদে-র ‘জাস্টিন এট জুলিয়েট’ বাঁধাই করা হয়েছিল এক মহিলার চামড়া দিয়ে। অন্যদিকে ফ্রান্সের আরেকটি বই ‘এরাটিকা’ বাঁধাই করা হয় মানুষের চামড়ায়। সমকাম নিয়ে ফ্রান্সের লেখক অ্যাডলফে বেলোত-এর লেখা উপন্যাস ‘মাদামোইসলে গিরাউদ’ সে দেশে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এই বইটির মলাটে ব্যবহৃত চামড়াটি এক মার্কিন মহিলার। ফিলাডেলফিয়ার একটি হাসপাতালে যক্ষ্মায় তিনি মারা যান।
চিকিৎসক আন্দ্রেস ভেসালিয়াস অনেক মানুষের দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করে ওই সময়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার পর তিনি অদ্ভুত সব আর্ট কালেকশন শুরু করেন। পাশাপাশি বইয়ের মলাট তৈরি করেছিলেন মৃত মানুষের চামড়া থেকে। তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা অনেক অভাবী মানুষ দুরারোগ্য ব্যধিতে মারা যাওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত মৃতদেহ দাবি করেননি। সেইসব মৃতদেহ শবচ্ছেদসহ নানা পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া ডাক্তার ভেসালিয়াস তাদের চামড়া দিয়ে নিজের লেখা বেশ কিছু বই বাঁধাই করেন। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের হে লাইব্রেরিতে এখনও কয়েকটি বই আছে।
এক সময়ে ফ্রান্সে শল্য চিকিৎসার প্রসারের জন্য মৃতদেহের বেশিরভাগ সংগ্রহ করা হত চরম সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের থেকে। ফরাসি ডাক্তাররা ময়নাতদন্তের সময় কিংবা ডিসেকশনের আগে তাদের শরীর থেকে চামড়া খুলে নিতেন। এরপর সেই চামড়া বিশেষভাবে ট্যান করে তা দিয়ে বইয়ের মলাট দেওয়ার কাজে লাগাত। প্রসঙ্গত; উইলিয়াম বার্কের কথা বলা যেতে পারে যার চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছিল একটি পকেট সাইজের বই। ডাক্তারদের কাছে মরা মানুষ বিক্রি করে টাকা পাওয়ার লোভ সে একজন সিরিয়াল কিলারে পরিণত হয়। সেই লোভে বার্ক মানুষ হত্যা করে তাদের বিক্রি করত বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে। তারপর ধরা পড়ার পর তার মৃত্যুদণ্ড হয়। তার চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা বইটি এখনও রক্ষিত আছে এডিনবার্গে সার্জন হল জাদুঘরে।
মিশেল ফুঁকো তাঁর ‘দি বার্থ অব দি ক্লিনিক’ বইতে মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধাই ও তাতে ডাক্তারদের ভূমিকা প্রসঙ্গে দেখিয়েছেন ফরাসি বিপ্লবের পর ডাক্তাররা চিকিৎসা শাস্ত্রের যেমন অনেক উন্নয়ন ঘটিয়েছেন পাশাপাশি তারা একের পর এক চিকিৎসা করতে করতে বিরক্ত হয়ে রোগীদের মানুষ না ভেবে ‘ডিজএমবডিয়েড সিম্পটম’ কিংবা সমাজের রুগণ অঙ্গ মনে করতেন। মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধাই এমনি চিন্তার প্রতিফলন। কেবল তাই নয়; ডাক্তারদের কেউ কেউ মনে করেছেন মৃত রোগীর চামড়া দিয়ে তাদের মূল্যবান বইগুলি বাঁধাই করা দোষের কিছু না।
১৭৮৯ সাল নাগাদ ‘ডিক্লারেশন অব দি রাইটস অব ম্যান অ্যান্ড সিটিজেন’ ঘোষণার পর ১৭৯৩ সাল নাগাদ ফ্রান্সের সংবিধান সংশোধন হলে মানুষের চামড়ায় বই বাঁধাই বন্ধ হয়। মানুষের অঙ্গ দিয়ে তৈরি কিছু কার্যত অনৈতিক ও অমানবিকতার স্মারক। ফলত মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বই আর সব বইয়ের মতো সেলফে রাখার বৈধতা হারায়।
Post Comment
কোন মন্তব্য নেই