হেসে খেলে সন্তানের হোমওয়ার্ক
কোন বাড়ি দেখেছেন, যেখানে বাচ্চার পড়া নিয়ে হইচই নেই? মা-বাবা বিব্রত নন তাদের সন্তানের হোমওয়ার্ক নিয়ে? কিভাবে এই নিত্যদিনের সমস্যা দূর করে আয়াসে হোমওয়ার্ক করাতে পারবেন তারই পরামর্শ দেয়া হলো।
নির্দিষ্ট সময় পড়ান:
শিশুদের পড়ানোর জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় স্থির করে নিন। পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে বের করতে চেষ্টা করুন কোন সময়টা শিশুকে পড়ানোর জন্য ঠিক হবে। অর্থাৎ আপনার যদি কোন পারিবারিক কাজ (যেমন রান্না করা বা দাওয়া-খাওয়া ইত্যাদি) বাকি থাকে, তাহলে বাচ্চাকে পড়ানোর সময় বার বার উঠতে হতে পারে। তাতে পড়ানোর ব্যাঘাত ঘটবে, বাচ্চা মনসংযোগ করতে পারবে না, ফলও খারাপ হবে। তাই সব কাজ শেষ করে পড়াতে বসান (অথবা পড়ানোর পরে বাকি কাজ করুন)। প্রতিটি পরিবারের কাঠামো আলাদা, প্রয়োজনও ভিন্ন। কোন বাচ্চার হয়ত সকালে স্কুল কারও বা দুপুরে। এসব বিষয় মনে রেখে, বাচ্চার স্বাস্থ্য ও অভ্যাস বুঝে তার পড়াশোনার সময় নির্দিষ্ট করুন।
প্রসঙ্গত এও জানিয়ে রাখা ভাল যে, বাচ্চার জন্য পড়ানোর সময় নির্ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার বাকি কাজগুলোর জন্যও একটা রুটিন তৈরি করুন। যেমন সকালে কখন ব্রেকফাস্ট করবে, দুপুরে কখন বিশ্রাম নেবে, কখন খেলতে যাবে, কখনই বা ঘুমানোর সময়। হতে পারে কোনদিন হোমওয়ার্ক বেশি থাকলে সেদিন হয়ত খেলতে পাঠালেন না। কিংবা একটু দেরি করে ঘুমোতে গেল।
হোমওয়ার্ক করানোর নির্দিষ্ট সময় স্থির করার অর্থ তাকে কতক্ষণ পড়াবেন সেটাও ঠিক করে ফেলা। এটা অবশ্য নির্ভর করবে আপনার বাচ্চাটি কতক্ষণে তার পড়াটা বুঝে নিচ্ছে। কোন অঙ্ক একটি বাচ্চা পাঁচ মিনিটে বুঝে নিতে পারলেও অন্যজনের হয়ত লাগে পঁচিশ মিনিট। আবার একটি ক্লাস থ্রির বাচ্চা ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তার হোমওয়ার্ক করে ফেলতে পারলেও ক্লাস সেভেনে যে পড়ছে তাকে নিশ্চয়ই আরও ঘণ্টাখানেক-ঘণ্টা দেড়েক বেশি সময় দিতে হবে। প্রয়োজনে বাচ্চার পড়ার জায়গায় একটা চার্ট বা রুটিন করে টাঙ্গিয়ে দিন। বাচ্চার এবং আপনার দু’জনেরই সুবিধা হবে।
মনঃসংযোগ বাড়াতে
বাচ্চাকে পড়ানোর সময় বাড়ির টেলিভিশন যেন বন্ধ থাকে। অন্য ঘরে পড়লেও টেলিভিশন চললে, তার আওয়াজ কানে এলে বাচ্চা অন্য মনস্ক হয়ে যেতে পারে।
টেলিফোনে (বা মোবাইল ফোনে) কথা বলবেন না। যেটুকু সময় বাচ্চাকে পড়াচ্ছেন সেই সময় মোবাইল বন্ধ রাখুন।
আপনার যদি বড় পরিবার হয় অথবা ছোট বাড়িতে থাকেন তাহলে কথাবার্তার আওয়াজ বা আড্ডার রেশ এসে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে বাচ্চাকে পড়ানোর সময় সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোলাহল বেশি না হয়।
সবকিছু হাতের কাছে রাখুন
পড়াতে গিয়ে দেখলেন শার্পনার নেই, রুলারটা ভেঙ্গে গিয়েছে কিংবা লাল কালার ক্রেয়নটা হারিয়ে গিয়েছে, তখন আপনি বিপদে পড়বেন। পড়ানো বন্ধ রেখে ছুটতে হবে দোকানে। তাই বাচ্চার ওপর রাগ না করে ওর প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস হাতের কাছে রাখুন। বাচ্চারা সব সময় গুছিয়ে বলে উঠতে পারে না, তাই পড়ানোর সময় নষ্ট না করার জন্য এটুকু আপনাকেই করতে হবে। (এক সঙ্গে বেশি জিনিস কিনলে ডিসকাউন্ট পাবেন, এতে আপনার আখেরে সাশ্রয় হবে)।
বাচ্চাকে বলবেন জিনিস ফুরিয়ে যাওয়ার আগে যেন নোটিশ দেয়। হারিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে বলবেন। বাচ্চাকে বুঝতে দেবেন না যে আপনি সবকিছু স্টক করে রেখেছেন।
নজির গড়ুন
বাড়ির সবাই (বিশেষ করে অভিভাবক/বাবা-মা) যদি নিয়মিতভাবে পড়েন, লেখেন বা এমন কিছু করেন যার সঙ্গে বোধ এবং ভাবনা জড়িত তা হলে তার প্রভাব শিশুর ওপর পড়বে। বাচ্চা যদি দেখে যে তার মা-বাবা বা পরিবারের সদস্যরা সব সময়ই টিভি দেখছেন, বেড়াতে যাচ্ছেন, বাজার কিংবা শপিংয়ে ব্যস্ত আছেন, তাহলে বাচ্চারও ওই সব বিষয়েই আগ্রহ বাড়বে। শত চেষ্টাতেও তাদের ঠিকমতো পড়ানো মুশকিল।
লেখাপড়া ভাবনা-চিন্তার পরিবেশ তৈরি হলে আপনার প্রতি বাচ্চার শ্রদ্ধাও তৈরি হবে।
বাচ্চাকে খেলনা দেয়ার সময় বা টিভি কিংবা অন্য কোন কিছু দেখানোর সময় মনে রাখা দরকার যে সেগুলো যেন তাদের পক্ষে শিক্ষর্ণীয় হয়।
আগ্রহ দেখান
অনেক মা-বাবা তাদের নিজেদের কাজের জন্য বাচ্চাকে সময়ই দিয়ে উঠতে পারেন না। এটা একেবারেই ঠিক নয়। যেমন করেই হোক মা বা বাবাকে (অন্তত কোন একজনকে) সন্তানকে দেয়ার জন্য সময় বার করতেই হবে। তবে তড়িঘড়ি বাইরে থেকেই এসেই বাচ্চাকে পড়তে বসার জন্য তাড়া দেবেন না। তার আগে বাচ্চার সঙ্গে সারাদিনের সুখ-দুঃখের কথা বলবেন। হাসি-মশকরা করবেন, তারপর পড়াতে বাসাবেন। এ সময় অফিসের সমস্যা মাথা থেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন। বাচ্চাকে পড়ানোর সময় বর্তমান নিয়মকানুন বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকুন। সহপাঠী বাচ্চার অভিভাবক বা স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। পড়াশোনার ব্যাপারে এমন পরিবেশ তৈরি করুন যাতে বাচ্চা বুঝতে পারে পড়াশোনাটা কত জরুরী তা হলে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হোমওয়ার্ক করবে।
হোমওয়ার্ক করান আরামে
আপনার বাচ্চা কিভাবে হোমওয়ার্ক করলে ওর ভাল লাগবে তা বুঝতে চেষ্টা করুন।
যেখানে সেখানে পড়াতে বসালে বাচ্চা মনোযোগী নাও হতে পারে। বাচ্চা যেখানে বসে পড়তে পছন্দ করে সেই জায়গাই বেছে নিন। অবশ্য সেখানে যেন আলোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে।
এ ছাড়া জায়গাটি বাচ্চার পছন্দমতো সাজিয়ে নিন। প্রয়োজনে হোমওয়ার্ক করানোর মাঝে ব্রেক দিন মিনিট পনেরো। একটু নিজের মনে খেলে নিতে দিন। এতে তো ক্ষতি হবেই না বরং নতুন উদ্যোগে আবার হোমওয়ার্ক করতে বসবে।
কিছু পরামর্শ
খেয়াল রাখবেন পড়া যেন জুজুবুড়ি না হয়। বেশিরভাগ বাচ্চারই পড়াশোনাতে একটা ভয়, কারও বা অনাগ্রহ। এতে বাচ্চার দোষ তেমন নেই বললেই চলে। সমস্যার শিকড় আমাদের সিস্টেমের।
প্রতিটি স্কুলের নিয়ম আলাদা। প্রথমে আপনার বাচ্চার স্কুলের প্রতিটি নিয়ম সম্পর্কে জেনে নিন।
বাচ্চার জন্য গৃহশিক্ষক রাখলেই ভাবলেন, আপনার দায়িত্ব আর রইল না। এটা একেবারেই ঠিক না। গৃহশিক্ষক থাকলেও পড়াশোনার খোঁজ নিন। নিজেও অবসর করে পড়ান।
অবশ্যই বাচ্চাকে পড়া গিলিয়ে দেবেন না। বাচ্চাকে সাহায্য করুন। তবে স্বাবলম্বী হতে একা পড়তে দিন। শেষ হলে পরখ করে নিন ঠিকমতো করতে পেরেছে কিনা।
আজকাল বাচ্চাদের জন্য টেলিভিশন একটা বড় সমস্যা। অনেক সময়েই ওরা আবদার করে যে অমুক প্রোগ্রামটা হয়ে গেলেই পড়তে বসবে। এই অভ্যাসের দাস যেন না হয়। ওদের টেলিভিশন দেখার সময় নির্দিষ্ট করে দেবেন এবং কোন অনুষ্ঠান দেখবে সেটাও ঠিক করে দেবেন। আসলে অনেক ক্ষেত্রেই টেলিভিশনের আড়ালে বাচ্চারা হোমওয়ার্ক এড়িয়ে যেতে চায়।
আপনার বাচ্চা কিভাবে হোমওয়ার্ক করলে ওর ভাল লাগবে তা বুঝতে চেষ্টা করুন। কারও হয়ত হাল্কা গান বাজালে ভাল লাগে, কেউবা মাটিতে ছড়িয়ে পড়তে ভালবাসে। এই বিশেষ ভাল লাগাগুলোকে তুচ্ছ করবেন না। এতে সমস্যাটা সরল হয়ে যাবে।
লেখক: আহছান হাবিব
পরিচালক, আদশা আল-হাসানাহ একাডেমি

কোন মন্তব্য নেই