বাংলাদেশের ফুটবলে সমস্যা কোথায়?
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল এখন বাংলাদেশের ফুটবলারদের কাছে যেন সোনার হরিণ৷ গত সাত সাফের একটিতেও ফাইনালে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ৷
যে নেপাল, ভুটান কিংবা মালদ্বীপকে একসময় গুনে গুনে গোল দিত, তারাই এখন বাংলাদেশের কাছে অপ্রতিরোধ্য৷
কিন্তু কী কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ? এটা কি ফুটবলারদের সমস্যা? নাকি ফুটবল ফেডারেশন আর ক্লাবগুলোর? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷
শিক্ষিত ফুটবলারের অভাব
বাংলাদেশের একমাত্র উয়েফা প্রো লাইসেন্সধারী কোচ মারুফুল হক প্রায়ই বলেন, দেশে শিক্ষিত ফুটবলারের বড্ড অভাব৷ শিক্ষিত বলতে তিনি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার কথা বলেননি৷ আধুনিক ফুটবল শিক্ষা না থাকার বিষয়টিকে বুঝিয়েছেন৷
আসলেও তাই৷ ছোটবেলা থেকে আধুনিক ফুটবল জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠেছে এমন ফুটবলার দেশে নেই বললেই চলে৷ না থাকাটাই স্বাভাবিক৷ কারণ স্বাধীনতার এতো বছর পরও দেশে একটা সাধারণ মানের একাডেমি গড়ে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন৷ দু'বার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু পরিকল্পনা না থাকায় দুটোই বছর ঘুরতে না ঘুরতে বন্ধ হয়ে যায়৷
এরমধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছ থেকে লিজ নিয়ে অনেক জাঁকজমকভাবে সিলেট বিকেএসপিকে ২০১১ সালে একাডেমি হিসেবে চালু করে বাফুফে৷ ফিফার কাছ থেকে টাকাও পায়৷ অথচ সেই টাকার অভাব দেখিয়ে সেটা বন্ধও করে দেয় বাফুফে৷
এরপর ফর্টিজ গ্রুপের সহযোগিতায় ঢাকার বেরাইদে দ্বিতীয় দফায় একটি একাডেমি করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন৷ কিন্তু কী এক অজানা কারণে সেই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি৷
অথচ অনেক আগেই দেশে একাধিক একাডেমি গড়ে তোলা উচিত ছিলো বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি৷ তিনি বলেন, একাডেমি গড়তে না পারলে, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বিকেএসপিগুলোতে ভালো মানের কোচ দিয়ে বাছাই করা প্রতিভাবান কিশোর ফুটবলারদের গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে পারে বাফুফে৷
অথচ বাংলাদেশের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল কিংবা ভুটানের রয়েছে একাধিক ভালো মানের একাডেমি৷ সেসবের সুবিধা যে তারা হাতেনাতে পাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে এই দেশগুলোর ফলাফল তার প্রমাণ৷ সঙ্গে ফিফা ব়্যাংকিংতো আছেই৷
ফুটবলার উঠে আসার পথ সংকীর্ণ
একদিকে স্বীকৃত একাডেমি না থাকা, অন্যদিকে তরুণ ফুটবলার উঠে আসার যে কয়টি পথ দীর্ঘদিন চালু ছিল, সেগুলো প্রশস্ত তো হয়ইনি, উলটো আরও সংকীর্ণ হয়েছে৷ ফুটবলার তৈরির সূতিকাগারখ্যাত পাইওনিয়ার ফুটবল লিগ একেবারে অনিয়মিত৷ এই প্রতিযোগিতার সর্বশেষ আসর হয়েছে দুই বছর আগে, ২০১৯ সালে৷ অথচ এই পাইওনিয়ার ফুটবল লিগে অংশ নেয় ৭০ থেকে ৮০টি ক্লাবের প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার ক্ষুদে ফুটবলার, যারা ধাপে ধাপে উঠে আসে প্রিমিয়ার লিগে৷ পাইওনিয়ার লিগের মতো বাধ্যতামূলক টুর্নামেন্ট নিয়মিত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন দীর্ঘদিন এই প্রতিযোগিতায় কোচ হিসেবে কাজ করা কামাল বাবু৷
আর ঢাকার বাইরের জেলা কিংবা বিভাগীয় ফুটবল লিগের অবস্থা আরও করুণ৷ সংশ্লিষ্ট জেলার কর্তাদের মন চাইলেই কেবল মাঠে গড়ায় ফুটবল লিগ৷ এনিয়ে এবছর মার্চে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন বাফুফে সভাপতি৷ লিগ নিয়মিত করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট জেলার বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটা ঘোষণাতেই আছে৷ আগের মতোই চলছে ঢাকার বাইরের ফুটবল৷ দু'একটি জেলায় শুরু হলেও, সেগুলোকে লিগ বলা রীতিমতো অন্যায়৷ কারণ কোনো রকমে দুচারটি দল গড়ে অনেকটা পিকনিক মুডে শেষ করা হয় খেলাগুলো৷
স্পন্সর থাকার পরও ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে সর্বাধিক ৪৫টি জেলায় হয়েছিল ফুটবল লিগ৷ এরপর ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দেশের কোনো জেলাতেই ফুটবল হয়নি৷ তবে ব্যতিক্রম ছিলো ২০১৮ সাল৷ বাফুফে এবং সাইফ পাওয়ারটেক জেলাগুলোকে টাকা দেয়ায় সেবছর সর্বাধিক ৫২টি জেলায় হয়েছিলো ফুটবল লিগ৷ এরপর আবার ফিরেছে আগের রূপে৷ অর্থাৎ বেশিরভাগ জেলাতেই ঠিকমতো হচ্ছে না ফুটবল লিগ৷
এ নিয়ে জেলার ফুটবল কর্তাদের ওপর রীতিমতো ক্ষুদ্ধ খোদ বাফুফের কর্মকতারা৷ ঢাকা থেকে জেলা লিগগুলো তদারকি করেন ফুটবল ফেডারেশনের এক্সিকিউটিভ মোজ্জামেল হোসেন মিঠু৷ তিনি বলেন, ফেডারেশন থেকে টাকা নেওয়ার পরও লিগ বা টুর্নামেন্টের আয়োজন করে না এমন জেলার সংখ্যা অনেক৷ এরমধ্যে কক্সবাজার আর নারায়ণগঞ্জের কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন৷ মিঠু বলেন, গত সাত বছরে কোন ফুটবল লিগ করেনি কক্সবাজার জেলা ফুটবল এসোসিয়েশন৷
নিয়মিত কোচ বদল
ফুটবল কোচের চাকরি সবসময়ই অনিশ্চয়তায় ভরা, এটা মোটামুটি সবারই জানা৷ তবে বাংলাদেশের মতো অনিশ্চয়তা বোধহয় পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই৷ কারণ স্বাধীনতা পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪৮ জন কোচ বদল করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন৷ আর কাজী মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের গত ১৩ বছরের শাসনামলে ২০ জন কোচ পরিবর্তন করেছে বাফুফে৷ এরমধ্যে সবচেয়ে ভাগ্যবান ইংল্যান্ডের জেমি ডে৷ ২০১৮ সালের মে থেকে এবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন বছরের বেশি সময় কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি৷ এর বাইরে এক থেকে পাঁচ মাস করেছেন এমন কোচও আছেন বেশ কয়েকজন৷
গত ৫০ বছরে ইউরোপ, ল্যাটিন, স্প্যানিশ এবং এশিয়ান ঘরানার কোচের স্পর্শ পেয়েছে বাংলাদেশের ফুটবল৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কোনো কোচকেই সেভাবে সময় না দেয়ার কারণেই বাংলাদেশের খেলার ধরন তৈরি হয়নি বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ হাসানুজ্জান খান বাবলু৷ তিনি বলেন, এরফলে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কোচের কৌশলের পরীক্ষার শিকার হচ্ছেন দেশের ফুটবলাররা৷ উপমহাদেশের অন্যদেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার এটিও অন্যতম কারণ বলে জানান জাতীয় দলের অধিনায়ক বাবলু৷
মানসম্পন্ন মাঠের অভাব
বাংলাদেশের ফুটবলের প্রাণভমরা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম৷ কিন্তু সেটাও কি আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন? উত্তর পুরোপুরি না৷ তারপরও এই একটি মাঠ প্রিমিয়ার লিগের ১৩টি ক্লাবের মধ্যে সাতটির হোম ভেন্যু৷ এই তথ্য থেকেই পরিষ্কার হয় বাংলাদেশে ফুটবল মাঠের সংকট কতোটা প্রকট৷ ভালো খেলোয়াড় তৈরির জন্য ভালো মানের কোচের পাশাপাশি ভালো মাঠের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘দেশের বাইরে খেলতে গেলে বুঝতে পারি আমরা কতটা খারাপ মাঠে ফুটবল খেলি৷’’ বিষয়টি ম্যাচেও প্রতিপক্ষের সঙ্গে পার্থক্য গড়ে দেয় বলে মনে করেন মামুনুল৷
ক্লাবগুলোর বয়সভিত্তিক দল না থাকা
খেলোয়াড় তৈরির পাইপ লাইন যদি হয় বয়এ বিষয়ে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের হেড কোচ হিসেবে কাজ করা সাইফুল বারী টিটু বলেন, এএফসির ভিশন এশিয়া প্রকল্প কাজে লাগিয়ে ক্লাবগুলোর জন্য বয়সভিত্তিক ফুটবল বাধ্যতামূলক করেছে ভারত৷ পরে ফ্র্যাঞ্চাইজি আসর আইএসএলের ক্লাবগুলোর জন্যও বয়স ভিত্তিক দল রাখা বাধ্যতামূলক করেছে অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন৷ যার ফলাফল এখন পেতে শুরু করেছে ভারত৷ বিশেষ করে এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতীয় পাঁচ থেকে ছয়জন আছেন যারা ক্লাবগুলোর বয়স ভিত্তিক দল থেকে উঠে এসেছেন৷
শিক্ষিত কোচের অভাব
গত দুতিন বছর মাঝে মাঝেই কোচেস কোর্স পরিচালনা করছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন৷ এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ৷ কিন্তু এসব কোর্স করা কোচদের কতজন কাজ করছেন দেশের তৃণমূল ফুটবলের সঙ্গে, সেটা একটা গবেষণার বিষয়৷
তবে দেশে যে ভালো মানের কোচের অভাব তা স্পষ্ট হয় প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর ডাগ আউটের দিকে তাকালে৷ ১৩টি ক্লাবের মধ্যে শুধুমাত্র পাঁচটি ক্লাবে আছেন স্থানীয় কোচ৷ বাকি সবাই আস্থা রাখছে বিদেশি কোচদের ওপর৷
কিন্তু এটা দেশের ফুটবলের জন্য ভালো ইঙ্গিত নয় বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক৷ প্রয়োজনে বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়ে প্রতিটি জেলায় একজন বা একাধিক ভালো মানের কোচ নিয়োগের জন্য বাফুফেকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি৷ যাদের কাজ হবে, জেলার প্রতিটি থানার খেলাগুলো পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রতিভাবান ভালো খেলোয়াড় চোখে পড়লে তাদের জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা৷ সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলার স্থানীয় কোচদের ভুলত্রুটি সংশোধন করে দেয়া৷সভিত্তিক প্রতিযোগিতা, তবে সেই জায়গাটাতে এখনও সেভাবে কাজই শুরু হয়নি বাংলাদেশের ফুটবলে৷ সাইফ স্পোর্টিং কিংবা বসুন্ধরা কিংস ছাড়া কোনো ক্লাবেরই বয়সভিত্তিক কোনো দল নেই৷ এমনকি আবাহনী-মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাব এই দিকটির গুরুত্বই অনুধাবন করতে পারেনি৷ অথচ ক্লাবের বয়স ভিত্তিক দল থাকলে লাভবান হয় নিজেরাই৷ কম খরচে গড়ে তোলা ফুটবলারকে নিজেদের সিনিয়র দলে খেলাতে পারেন অনায়াসে৷ যা করে থাকে, পৃথিবীর সব পেশাদার ক্লাব৷
Post Comment
কোন মন্তব্য নেই