আলভেসের চোখে সময়ের সেরা নেইমার, সর্বকালের সেরা মেসি
তার ডাক নাম ‘এল লোকো’ বাংলায় অর্থ করলে হবে পাগল। মাঠে এবং মাঠের বাইরে তিনি মজার এক ব্যক্তিত্ব। নামটা সেখান থেকেই এসেছে। তবে মজার এই মানুষটির শুরুর দিনগুলো ছিল ভীষণ কঠিন। জীবন সংগ্রামে অভাব-অনটনসহ নানা প্রতিকূলতার সাথে তার পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু তিনি সেখান থেকে হারিয়ে যেতে চাননি। স্বপ্ন দেখেছিলেন বিশ্ব জয়ের। মনের আনন্দে ফুটবল খেলতে খেলতে হতে চেয়েছেন সেরাদের সেরা। লম্বা ক্যারিয়ারে দৃঢ় সংকল্পের ডানায় চড়ে সব বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে তিনি পূরণ করেছেন শৈশবের স্বপ্ন। গল্পটা ব্রাজিলের জুয়াজেইরো গ্রামের এক বালকের, গল্পটা ইতিহাসের সেরা রাইট ব্যাকদের একজন দানি আলভেসের।
বয়স হয়েছে ৩৮, তবে এখনো স্বপ্নের পেছনে আলভেসের ছুটে চলা থেমে নেই। একটি চ্যালেঞ্জ সম্পূর্ণ করে নিজেকে দিচ্ছেন নতুন লক্ষ্য। তাতে সুদীর্ঘ এই পথচলায় তার শিরোপার শোকেসও হয়ে উঠেছে পূর্ণ। পেশাদার ক্যারিয়ারে জিতেছেন রেকর্ড ৪৩ টি শিরোপা। সাবেক বার্সেলোনা, ইউভেন্তুস ও পিএসজি তারকা এখন খেলছেন ব্রাজিলের ক্লাব সাও পাওলোতে। সেখানে খেলেই নিজেকে প্রস্তুত করতে চান কাতার বিশ্বকাপের জন্য। এরই মাঝে চমক হয়ে এসেছে তার টোকিও অলিম্পিকে খেলার ঘোষণা। ব্রাজিলের ২৩ বছরের বেশি বয়সী তিনজন খেলোয়াড়ের একজন আলভেস।
ফিফার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে আলভেস কথা বলেছেন তার অলিম্পিকে খেলা, সামনের লক্ষ্য, ব্রাজিলের হয়ে আরেকটি বিশ্বকাপ খেলার ইচ্ছা, বেড়ে ওঠার দিন, বার্সেলোনার হয়ে খেলার সময়, নেইমার এবং মেসিকে নিয়ে।
ব্রাজিল কোচ আন্দ্রে জারদিনে বলেছেন, তিনি যখন আপনাকে অলিম্পিক দলে খেলার প্রস্তাব দেন তখন নাকি আপনার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। সেই মুহূর্তে কেমন লেগেছিল?

আপনার বয়স হয়ে গেছে ৩৮ বছর। (নিয়মানুযায়ী) ব্রাজিল মাত্র তিন জন (২৩ বছরের বেশি) খেলোয়াড় নিতে পারতো। আপনি কি ভেবেছিলেন, আপনার অলিম্পিকে খেলার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে?
আলভেস: কখনোই মনে হয়নি আমার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। নিজের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে- আমি যেভাবে নিজের যত্ন নিই, যেভাবে প্রস্তুতি নিই আর আমার পারফরম্যান্স। আমি আগে দুইবার সুযোগ হারিয়েছি, তৃতীয়বারের সুযোগে ব্রাজিলকে অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্ব করব এবার। সোনার পদক জয় করাটা হবে অনেক দায়িত্বের, তবে এটার জন্যই তো খেলছি। এই ধরনের চ্যালেঞ্জ আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শিরোপা জয়ী খেলোয়াড় আপনি। সেখানে অলিম্পিকে সোনা জয় আপনার কাছে কতটা গুরুত্ব বহন করে?
আলভেস: প্রতিটি শিরোপারই আলাদা গুরুত্ব আছে। তবে এর মাঝে কিছু আছে বিশেষ। আর অলিম্পিক হলো অন্যগুলোর চেয়ে স্পেশাল। এটা বিশ্বকাপের মতো। প্রতি চার বছর পর পর আসে। বিশ্বের সব সেরা অ্যাথলেট, সেরা দলগুলো খেলতে আসে। অলিম্পিক পুরো বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। আমাদের এই দলের খেলোয়াড়রা প্রথমবারের মতো অলিম্পিকে খেলবে, এটা হবে জাদুকরী একটি ব্যাপার। তবে আমাদের লক্ষ্যে মনোযোগী থাকতে হবে-দেশের জন্য আরেকটি সোনা জিততে হবে। জয়ের লক্ষ্যে আমাদের অবিচল থাকতে হবে।
আরেকটি বিশ্বকাপ খেলার ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?
আলভেস: সত্যি বলতে, এটাই আমার মূল লক্ষ্য। অলিম্পিকে ডাক পাওয়াটা আসলেই ভালো একটি সারপ্রাইজ ছিল, তবে পিএসজি ছাড়ার পর থেকে আমি নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছি যে বিশ্বকাপে খেলার জন্য আমি নিজেকে শতভাগ উজাড় করে দিব। জীবনে আপনাকে বড় লক্ষ্য ঠিক করতে হবে এবং সেটা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। কখনো আপনি সেটা অর্জন করতে পারবেন, কখনো পারবেন না। তবে এটা প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি, আমি যদি বিশ্বকাপে সুযোগ না পাই তাহলে সেটা আমার চেষ্টার ঘাটতির জন্য হবে না। জায়গা আমার প্রাপ্য না হলে আরেক জনের হবে। তখন আমি হবো দলের সবচেয়ে বড় সমর্থক। আমি সব সময়ই বিশ্বকাপের কথা ভাবি এবং এই স্বপ্ন পূরণে নিজেকে উৎসর্গ করেছি। এটাই হবে চূড়ান্ত (লক্ষ্য)।
নেইমারের ব্যাপারে আপনার মতামত?

সেই যাদুকরী ফুটবলার কারা, যারা আপনাকে ফুটবলের প্রেমে ফেলেছিল?
আলভেস: আমি ভালবাসতাম রোনালদিনিয়ো ও রোমারিওর জাদু। তবে আমার আদর্শ ছিল কাফু। জুয়াজেইরো থেকে এসে আমরা যাদুকরী হওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারতাম না। এই জায়গায় আসতে আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। আমার সীমানা ছিলেন কাফু। তার গল্প, তিনি যেভাবে লড়াই করতেন সেটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাই লোকে যখন কাফুর সঙ্গে আমার তুলনা করে আমি সেটা অপছন্দ করি। নিজের ওপর আমার অনেক বিশ্বাস আছে, আমার মনে হয় যেন, আমি হলিউডের অস্কার জিতেছি, তবে কাফুর প্রতি আমার সর্বোচ্চ সম্মান রয়েছে এবং এই ধরনের তুলনা আমি একেবারেই পছন্দ করি না। কাফু একজন কিংবদন্তি।
বার্সেলোনায় আপনার সময়টা কেমন ছিল?
আলভেস: অতুলনীয়। আমি বিশ্বাস করি, আমি ইতিহাসের সেরা ফুটবল দলে খেলেছি। এতোটা যাদুকরী কোন দল দেখিনি যারা সবদিক দিয়ে ছিল সুসংগত। ৯০ মিনিট আমরা একই তালে খেলতাম। বিশ্বসেরা মহাতারকারা সেখানে খেলত বাচ্চাদের মতো। আমরা শুধু জেতার জন্য খেলতাম না, বিনোদনের জন্যও খেলতাম। আমাদের ছিল একের পর এক অসাধারণ সব খেলোয়াড় এবং সেটার প্রতীক ছিল একজন যে সবার কাছে ছিল ভিনগ্রহের। এটা অন্যদের কাছে ব্যাখ্যা করা কঠিন, কারণ এই অনুভূতিটা কেবল সেই স্কোয়াডের সদস্যরা বুঝতে পারবে যাদের এই অভিজ্ঞতাটা হয়েছে। আমরা উপভোগ করেছি অপরিসীম উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত।
আপনি কি মনে করেন সেই খেলোয়াড়ই সর্বকালের সেরা ফুটবলার?

আপনার মতে এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ফুটবলার কে?
আলভেস: এই মুহূর্তে নেইমার বিশ্বের সেরা ফুটবলার।
আপনার বেড়ে ওঠার সময়টা বেশ কঠিন ছিল…
আলভেস: অনেক বাচ্চাদের জন্যই এটা কঠিন। আমি খুব ভাগ্যবান কারণ, আমার বাবা-মা সবসময় এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতেন যেন টেবিলে খাবার থাকে। তারা আমার হিরো হয়েই থাকবেন। তবে অন্য অনেক বাচ্চাদের যা ছিল তা আমার কাছে ছিল না। আমাকে অনেক অল্প বয়স থেকেই কাজ করতে হয়েছে। তবে একটা জিনিস আপনাকে জীবনের সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে সাহায্য করবে: স্বপ্ন। আপনার সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু আপনি যখন বড় স্বপ্ন দেখবেন, আপনার স্বপ্ন এতোটাই যাদুকরী যে সেটা আপনার চিন্তাজগতকে গ্রাস করবে, সঙ্কট নিয়ে আপনি আর চিন্তা করবেন না। অবশ্যই স্বপ্নপূরণে আপনাকে শতভাগ উজাড় করে দিতে হবে- স্বপ্ন দেখতে কেউ বাধা দিতে পারে না। আমার স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হওয়া।
ক্লাব ও জাতীয় দল মিলিয়ে আপনি ৪৩ টি সিনিয়র শিরোপা জিতেছেন। এটা ভাবতে কেমন লাগে যে আপনি হতে পারেন বিশ্বের প্রথম ৫০ টি শিরোপা জেতা ফুটবলার?
আলভেস: নিজেকে নিয়ে আমি গর্বিত। আমি চিন্তা করি, এসব অর্জনের জন্য আমাকে কত কষ্টকর পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি মনে করি, আপনার আকাশ সমান স্বপ্ন থাকতে হবে। হ্যাঁ, আমি চিন্তা করি, মাইলফলক নিয়ে। ৫০ শিরোপা! আমার মনে হয়, এটা হবে অসাধারণ, ঐতিহাসিক। আশা করি, অবসরের আগে আমি ৫০ স্পর্শ করতে পারবো এবং আশাবাদী এর মধ্যে বিশ্বকাপও থাকবে।
স্পোর্টস ডেস্ক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Post Comment
কোন মন্তব্য নেই